ফিরে যেতে চান

পূর্বলেখ

রাজশাহীর কথা’র পূর্ব নাম রাজশাহী মহানগরী কথা। যার আলোচ্য কেন্দ্রভূমি রাজশাহী মহানগরী। অনুষঙ্গক্রমে কেন্দ্র থেকে সম্প্রসারণ ঘটেছে জেলা ও বিভাগের পরিসীমায়। এর ঐতিহাসিক বিবরণ ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে গ্রন্থটিকে মহানগরীর সীমারেখায় চিহ্নিত করা যায় না। পাঠকের কয়েকজন তথ্য আয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরবর্তী সংস্করণ নামকরণের পরামর্শ দেন। বিষয়টি নিয়ে আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বিবলিওগ্রাফার মো. জামাল উদ্দিনের সঙে আলোচনা হয়। তিনি ‘রাজশাহীর কথা’ নামে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের পরামর্শ দেন। তাঁর প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত মনে হওয়ায় রাজশাহী মহানগরী’র কথার তৃতীয় সংস্করণ ‘রাজশাহী কথা’ নামে প্রকাশিত হলো।

রাজশাহীর কথা ইতিহাসভিত্তিক রচনা। তবে বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় প্রকৃত ঐতিহাসিক গ্রন্থ কি না- এ নিয়েও প্রশ্ন এসেছে। রাজশাহী মহানগরী কথা নামে এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণকে কেউ কেউ প্রকৃত ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলতে চাননি। গ্রন্থের ভূমিকা লেখক প্রফেসর ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেছেন ‘কম্পাইলড ওয়ার্কস’। তবে সব মন্তব্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা একটি গ্রন্থ। প্রয়োজনীয়তার কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে গ্রন্থটি গুরুতপূর্ণ। যার ফলে ২০০৪ ও ২০০৭ সালের পর ২০১৮ সালে এসে আবারো পরিবর্তিত নামে আকৃতি পেল।

দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পর রাজশাহী সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ আরো প্রবল হয়ে ওঠে। জানা থেকে নতুন নতুন প্রশ্ন এসে আমাকে আরো অজানা করে তোলে। সংস্করণদ্বয়ে পরিবেশিত অনেক তথ্যই বিভ্রান্ত করে ফেলে। অনুসন্ধানে গিয়ে পাই, প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থাপনকাল ও বিকাশের ধারাবাহিক বর্ণনায় নির্ভুল তথ্য লিপি হয়নি। আবার রেফারেন্স সংযোজনের ক্ষেত্রেও কিছু ত্রæটি দৃষ্টিতে আসে। বিভ্রান্তি দূরীকরণের যথার্থ সূত্র খুঁজতে গিয়ে নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এ যাবৎ প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থে পরিবেশিত সূত্র থেকে মৌলিক সন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, রাজশাহী সম্পর্কে এখনও ভালো গবেষণা হয়নি। শিক্ষা নগরীর খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদেরই নির্ভুল ইতিহাস গ্রন্থের আকৃতি দেয়নি। এমন কি সত্য অনুসন্ধানের খুব একটা প্রচেষ্টা হয়েছে বলে মনে হয় না। এ পরিস্থিতিতে জ্ঞানে গুণে গতিমান রাজশাহীর অনগ্রসরতার মৌল কারণ আবিস্কারে খুব গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রাজশাহী মহানগরীর কথাকে তৃতীয় বারের আকৃতি দেয়ার উদ্যোগটা এখান থেকেই আসে। ভাবনাটা ছিল এ রকম, আমি  যে ভুলগুলো উপস্থান করেছি অন্তত সেগুলোরই সঠিক তথ্য পুনরায় উপস্থাপন আমারই কর্তব্য। তবুও পরের ভাবনা পরিকল্পনায় গৃহীত ধাপকে অনেকটা অচল করে দেয়। অভিজ্ঞতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল- যেখানে গবেষণা, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সেখানেই অর্থ ব্যয়ের যোগসূত্র বিদ্যমান। স্বাভাবিক জীবন ধারণের প্রয়োজনীয়তা বরাবরই যখন আমার নাগালের বাইরে অবস্থান নিয়ে আসছে; তখন গবেষণা ও প্রকাশনার ব্যবধান অস্বাভাবিক। সেটা যে শুধু আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আছে তা নয়; বাংলা আকাশের নক্ষত্র ও রাজশাহীর মহাগুণী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ও খ্যাতনামা শিল্পী শ্রী অর্দ্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, মিউজিয়াম ভবন নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্রন্থাদি প্রকাশের ব্যয়ে যেতে পারছেন না। নিজের অন্যান্য প্রয়োজন কমতির লড়াই কিংবা দেনার অংকে পাÐুলিপি প্রস্তুতের পর আমাকে ভাবতে হয়েছিল ক্রেতা পাঠকের পরিসংখ্যান। পূর্বের দুটি সংস্করণের পরিণতি কি হয়েছিল? পূর্বের সংস্করণ দুটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল আনিকা-আস-আদ প্রকাশনী ও আলীগড়। আলীগড় পেশাদার প্রতিষ্ঠান হলেও ব্যবসার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে রাজশাহী মহনগরীর কথা তার কাছে পুনরায় মুদ্রণ হতে পারেনি। তাই বলে এর পরিত্যক্ত লটে উই বা ঘুণপোকা বাসা নির্মাণ করে সুখে দিনাপাত করার সুযোগ পায়নি। অনেক দিন থেকে এর কোন কপিই বাজারে নেই। প্রয়োজনের তাগিদে অনেকে গ্রন্থটির আংশিক বা পুরোপুরি ফটোকপির উপর নির্ভরশীল হয়েছেন এবং গ্রন্থটিকে আবারো বাজারে নিয়ে আসার বিষয়ে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁদের উৎসাহে বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা সিদ্ধান্তের আকৃতি পেয়ে যায়। তখনই বাস্তবতা নিরেট হয়ে ওঠে।

শুধু গ্রন্থ ও প্রবন্ধে পাওয়া সরল তথ্য বা ধারণা থেকে ‘রাজশাহী কথা’ নির্মাণ নয়। রাজশাহীতে যা ছিল ও যা আছে তারই বাস্তব লিপি ছাপানোর প্রচেষ্টা আছে এবারের সংস্করণে। সত্যের অনুসন্ধানে বেরিয়ে পুরোটা সাফল্য আসেনি। আবার প্রচেষ্টাও হতাশ করেনি। যে বা যারা মৌলিক তথ্য উদ্ঘাটনে সহযোগী হয়েছেন, তাঁরা গ্রন্থের যথা স্থানে লিপি হয়ে গেছেন।

তথ্যানুসন্ধান ও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক ধাপ অতিক্রমের পর অর্জিত কর্ম গ্রন্থের আকৃতি ধারণের সুযোগ পেয়েছে। অনেকে সহযোগিতা দিয়ে সাফল্যের কাছে নিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রাজশাহী এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা, হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মাহবুবর রহমান, প্রথম আলো পত্রিকার গবেষণা উপদেষ্টা মুহাম্মদ লুৎফুল হক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন, নজরুল গবেষক ড. মোহা. আজমল খান, দৈনিক সোনার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাংবাদিক আকবারুল হাসান মিল্লাত, রাজশাহী সিটি প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও গবেষক মোহাম্মদ জুলফিকার, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. কাজী মো. মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট অঙ্কুর সেন, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. সফিকুল ইসলাম,  ফটো সাংবাদিক মো. সোহাগ আলী, গ্রাফিক্স ডিজাইনার খুরশীদ আল-মাহমুদ, রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মো. মহিউদ্দিন ও অফিস সহায়ক সোহেল, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের উপ-প্রধান সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল কুদ্দুস, বরেন্দ্র রিসার্চ লাইব্রেরী ইনচার্জ আসলাম রেজা, সহকারী রেজিস্ট্রার খন্দকার শামসুল আরেফিন, উচ্চমান সহকারী আকলিমা খানমের নাম স্মরণযোগ্য। যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা হয় না এমন কিছু উচ্ছিষ্ট কাগজ, পেপার কাটিং, পুরনো ম্যাগাজিন, ক্রেস্ট ইত্যাদি যতœসহকারে গুছিয়ে নগর ভবনের মেয়রের দপ্তর থেকে প্রক্রিয়াধীন রাজশাহী সিটি মিউজিয়ামে দিয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী মো. আশরাফুল আলম মানিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সহযোগিতায় প্রাপ্ত সামগ্রীসমূহ এ গ্রন্থ রচনায় মৌলিক তথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। কম্পোজে পুরোনো পাÐুলিপির অংশ বিশেষ থেকে যাওয়ায় গ্রন্থে নতুন-পুরোনো বানান রীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। পরবর্তী সংস্করণ হলে এ জ্ঞাত ভুল সংশোধনের প্রত্যাশা আছে।  মোঃ খাজা খালেদ লিজারের অত্যন্ত আগ্রহে ডেস্কটপ আইটি থেকে রাজশাহীর কথার প্রকাশ মানুষের উপকারে আসলে আমার, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও সহযোগীদের প্রচেষ্টা স্বার্থক হবে।

প্রায় ১৮ বছরের পরিশ্রমের ফসল রাজশাহী কথায় রাজশাহীর অতীত ও বর্তমানের সব বিবরণ লিপি হতে পেরেছে বা ত্রæটি মুক্ত হয়েছে দাবির সুযোগ নেই। বলা যায়, এটা একটা অভিযানের সামান্য অর্জন। কারণ অনুসন্ধানে মনে হয়েছে, প্রান্তবিহীন সময়ের মতো গবেষণা কর্মেরও যবনিকা বলে কিছু নেই।

আনারুল হক আনা